বিবিসি প্রকাশ
ভারতের গবেষকের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে জামায়াত নেতা তাহের বলেন—তাদের কোনো শরিয়া আইন আনার পরিকল্পনা নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের সম্পর্কেও খোলামেলা মত দেন।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন যেমন উত্তপ্ত, তেমনি প্রতিবেশী ভারতও নজর রাখছে পরিস্থিতির ওপর। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে দিল্লির নীতিনির্ধারক মহলে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে—দলটি কি সত্যিই বদলেছে, নাকি কেবল রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নতুন রূপ দেখাচ্ছে?
সাম্প্রতিক ঢাকায় সফরে ভারতের ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বাংলাদেশবিষয়ক গবেষক শ্রীরাধা দত্ত জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। সেই আলাপ থেকেই উঠে এসেছে জামায়াতের নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক বক্তব্য।
শরিয়া আইন প্রসঙ্গে নতুন বার্তা
তাহেরকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিল—জামায়াত যদি কখনো সরকার গঠনের মতো অবস্থানে পৌঁছায়, তবে কি দেশে শরিয়া আইন চালুর উদ্যোগ নেবে?
তাহেরের জবাব ছিল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন:
“এটা কোথায় শুনলেন? আমরা কখনোই বলিনি যে, ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশে শরিয়া আইন আনব।”
তার দাবি, জামায়াতের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রচলিত, তার অনেকটাই অতীতকেন্দ্রিক। নতুন প্রজন্ম জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে।
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে অবস্থান
মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকা প্রসঙ্গে তাহের স্বীকার করেছেন যে, অতীতে ভুল হয়েছে। তিনি বলেন—
“মতিউর রহমান নিজামি বা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো নেতারা প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থানের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। আমরা সেটি স্বীকার করেছি, অতীতকে আমরা অস্বীকার করছি না।”
তার কথায় বোঝা যায়, নতুন প্রজন্ম অতীতকে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোতে চায়, তবে ইতিহাসকে একেবারে মুছে ফেলতে নয়।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
ভারত প্রসঙ্গে তাহেরের বক্তব্য ছিল আরও কূটনৈতিক। তিনি বলেন—
“ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী—এটা স্বীকার করতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই। চট্টগ্রাম অস্ত্র পাচার মামলা হোক বা ২০০১-২০০৬ সালের ভারতবিরোধী নানা ঘটনা—এসব ক্ষেত্রে জামায়াতের সম্পৃক্ততার প্রমাণ কখনোই দেখানো হয়নি।”
তার দাবি, জামায়াত এখন ভারতের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়তে প্রস্তুত।
দিল্লির দ্বিধা
তাহেরের বক্তব্য জামায়াতের ভিন্ন চেহারা তুলে ধরলেও দিল্লির অনেক নীতিনির্ধারক এখনও সংশয়ে। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা মনে করেন, জামায়াতের অতীত ভুলে যাওয়া যাবে না। তার ভাষায়,
“চিতাবাঘ যেমন ডোরা বদলায় না, জামায়াতও কখনো চরিত্র পাল্টাবে না।”
এমন অবস্থায় দিল্লি এক জটিল প্রশ্নের মুখে—জামায়াতের নতুন প্রজন্মকে কি বাস্তববাদী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা হবে, নাকি পুরনো রেকর্ডের ভিত্তিতেই তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হবে?
জামায়াতের নতুন নেতৃত্ব নিজেদের আধুনিক রূপে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট। টেলিভিশন টক শোতে তরুণ নেতাদের উপস্থিতি, শরিয়া আইন অস্বীকার, মুক্তিযুদ্ধের অতীত স্বীকারোক্তি ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের আগ্রহ—সবকিছু মিলিয়ে তারা নিজেদের “জামায়াত ২.০” রূপে তুলে ধরতে চাইছে।
কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো—এটা কি সত্যিকারের রূপান্তর, নাকি কেবল রাজনৈতিক কৌশল?
ভারতের জন্য এখানেই সবচেয়ে বড় দ্বিধা। জামায়াতকে নতুন চোখে দেখা শুরু করলে এক বাস্তবতা, আর অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দূরে সরালে আরেক বাস্তবতা সামনে আসবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, জামায়াতকে ঘিরে ভারতের এই কূটনৈতিক সংকট ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সূত্র: বিবিসি ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫